প্রথম খুতবা:
আল্লাহর বান্দারা: আহলে ইলম ও জ্ঞানীরা আনন্দের সাথে একমত হয়েছেন যে,জামাতবদ্ধতা রহমত এবং বিচ্ছেদ একটি আজাব। মিশ্রণ বিচ্ছিন্নতার চেয়ে ভাল। জামাত থেকে বিজোড়তা অবাধ্য ও পথহারা। তিনজন হলে আরোহণকারী তবে একজন হলে শয়তান এবং দুজন হলেও শয়তান। দুটো জিনিস একত্র হলে যে শক্তি সঞ্চারিত হয়,বর্শা তা ভাঙতে পারে না। তবে বিচ্ছিন্ন হলে দুটোকেই একে একে ভেঙে ফেলে। স্বতন্ত্রতা সত্তাগতভাবে দুর্বল। তবে শক্তিশালী হয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। এটাই বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্য।
আর বান্দার জন্য আল্লাহর ভালবাসা ও সন্তুষ্টির এই ভিত্তির উপর গড়ে উঠেছে দুনিয়ায় ইমারত। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান।'(সুরা নিসা:১১৫)
আবূ দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,’তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি,কোন জনপদে বা বনজঙ্গলে তিনজন লোক একত্রে বসবাস করা সত্ত্বেও তারা জামা’আতে সলাত আদায়ের ব্যবস্থা না করলে তাদের উপর শয়তান আধিপত্য বিস্তার করে। অতএব তোমরা জামা’আতকে আঁকড়ে ধর। কারণ নেকড়ে বাঘ দলচ্যুত বকরীটিকেই খেয়ে থাকে।(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৫৪৭)
নবীজি আরো বলেছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হতে সাবধান থেকো। কেননা, শায়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দুজন হতে অনেক দুরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচাইতে উত্তম জায়াগার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে (মুসলিম সমাজে)। (জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ২১৬৫)
আল্লাহ নবীগণকে পাঠিয়েছিলেন, দ্বীন, সম্প্রতি ও সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার এবং সমস্ত বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা ছেড়ে দেয়ার জন্য। যেমনটি আল্লাহ তায়ালা তাঁর কিতাব দৃঢ়তার বলেছিলেন: আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।(আলে ইমরান:১০৩)
যেমনটি শাইখুল মুফাস্সীর ইবনে জারির কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন:সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাদের মধ্যে বিভেদকে ঘৃণা করেন এবং আপনাদের এ ব্যাপারে সতর্ক ও নিষেধ করেছেন।আপনাদের জন্য অনুকরণ, আনুগত্য, সম্প্রতি ও ঐক্যবদ্ধে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন। সাধ্যমত আল্লাহ তায়ালা যাতে সন্তুষ্ট হোন তাতে সন্তুষ্ট প্রকাশ করুন। আল্লাহ ব্যতীত কোন শক্তি নেই’
আল্লাহর বান্দারা! এ কথাগুলো উপলব্ধির পর জেনে রাখুন, ঐক্যবদ্ধতা এক প্রকারের রক্ষা কবজ। এই জামাতবদ্ধতা জরুরি একটি বিষয়। এর হেফাজতে ঐক্য গঠন করতে হয়। একে অন্যের সাথে মিলে মিশে থাকতে হয়। ঐক্য ভাঙনরোধে পরিকল্পিত ব্যবস্থা নিতে হয়।একতার বহির্ভূত সবাই বিচ্ছিন্নবাদী ও বিভেদকারী।
আল্লাহর বান্দারা! বিশ্বাস, চিন্তা, বাকশক্তি বা কর্মপদ্ধতিতে স্বতসিদ্ধ ও সঠিক পথ থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিরোধ অথবা কখনো সত্য, একতা বা নৈতিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটাই হলো বিচ্ছন্নবাদীতা।
আল্লাহর বান্দারা! শুজুজ বা বিচ্ছন্নবাদীতা- দুটি প্রকার। হয় অন্তরের না হয় অঙ্গের। অন্তরের বিচ্ছিন্নতা দুর্নীতিবাচক বিশ্বাস এবং ইমানদার ও তাওহীদবাদীদের সাথে বিরোধ করে ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার ভিত্তিতে তৈরি হয়। অঙ্গের বিচ্ছন্নতা ঘটে,কখনো পরিত্যাগের মাধ্যমে ঘটে। আবার কখনো কাজের মাধ্যমে।
পরিত্যাগের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতা হলো,জাামাতের বিরুদ্ধে চলা। দায়িত্বশীলদের অমান্য করে চলা।এটি একটি সুস্পষ্ট বিপজ্জনক পথ এবং ভয়ঙ্কর মন্দের চিত্র। বিজ্ঞজনেরা সর্বসম্মতিক্রমে এই বিচ্ছিন্নতাকে অস্বীকার এবং এর বিরুদ্ধে সতর্ক করতে সম্মত হয়েছেন। এটি একটি বিরাগ ও অস্বীকৃতি।এই মতাদর্শে যারাই হোক না কেন, এ মতের সাথে কোন সমঝোতা নেই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি (আমীরের) আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে মৃত্যুবরণ করে সে কিয়ামাতের দিন আল্লাহর সাথে এমন অবস্থায় মিলিত হবে যে তার কোন দলীল থাকবে না। আর যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলো আর তার ঘাড়ে আনুগত্যের কোন চুক্তি নেই তার মৃত্যু জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু হবে।(মুসলিম,হাদিস নং ৪৬৮৭)
আল্লাহর বান্দারা! কার্যত শুজুজ বা বিচ্ছিন্নতা কখনো ফিকহি ফতোয়ার মাধ্যমে হয়। যা সংঘটিত হয়,ইসলামী আইনশাস্ত্রের পথ থেকে দূরত্বের কারণে।যা স্বীকৃত আইনশাস্ত্রীয় মতবিরোধের মধ্যে একটি স্পষ্ট বিভেদে পরিলক্ষিত। তবে বিচ্ছিন্নতা বলা হবে যখন এর সীমানা অতিক্রম করবে।
আর এটা জানা যাবে ফেকাহ শাস্ত্রের বিচ্ছিন্ন মতগুলো বা সুস্পষ্ট ঐকমত্যের বিপরীতে বিচ্ছিন্ন এমন ফতোয়া সম্পর্কে অবগতি লাভ করলে, যেগুলো শরিয়তের উদ্দেশ্য এবং সুস্পষ্ট কারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং এটি বিচ্ছিন্নতার এমন প্রকার যা থেকে কোন যুগই মুক্ত ছিল না। যার সাহায্যে বিচ্ছন্নবাদীরা সমাজের ফতোয়া ব্যবস্থা বিকৃত করে। শরিয়তের সঠিক ফতোয়া গ্রহণকারীদের বিভ্রান্ত করে। তখন সাধারণ লোকগুলো বিভ্রাট ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে।ফলস্বরূপ ফতোয়ার উৎস সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়। আল্লাহ ব্যতীত কোন শক্তি বা আস্থা নেই।
অনুরুপ বিচ্ছন্নতা ভাব ভঙ্গিতে এবং লেবাস পোশাকেও হতে পারে। যেমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের লেবাস পোশাক। তারা সাধারণ মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু পরে থাকেন। যেন নিজেদেরকে ভিন্ন ও আলাাদা ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,’যে ব্যক্তি খ্যাতি লাভের জন্য পোশাক পরে, ক্বিয়ামাতের দিন আল্লাহ তাকে সেরূপ পোশাক পরাবেন, অতঃপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে।'(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪০২৯)
খ্যাতির পোশাক বলতে বোঝায়, রীতিবর্জিত বাহ্যিক আত্মম্ভরিতা সম্বলিত পোশাক। যা গর্বের উদ্রেক সৃষ্টি করে। অনুরূপ মাত্রারিক্ত বিনয় প্রদর্শনে প্রচলন বহির্ভূত অবমূল্যায়িত এবং তপস্যাব্রত পোশাকও বিচ্ছিন্নবাদীতার আলামত। কারণ সালাফে সালেহীন এই দুই ধরনের পোশাকই অপছন্দ করতেন। এক হলো গর্বের পোশাক আরেকটা বৈরাগ্যের পোশাক।
তাহলে জেনে রাখুন! কার্যত বিচ্ছন্নতা হলো,আল্লাহ তায়ালা যে প্রকৃতি ও স্বভাবের সৃষ্টি করেছেন।মনস্তাত্ত্বিকভাবে এ স্বভাব ও প্রকৃতির পরিপন্থী কোন কিছু করা । যেমন,বিবাহর বিরোধিতা করা একটা বিচ্ছন্নতা। এ ব্যাপার আল্লাহর বাণী হলো,’মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত।'(সুরা নিসা:৩)
বিবাহ থেকে বিচ্ছিন্নবাদীরা একটি জঘন্য মতবাদ প্রচার করছে। অমুসলিম তো বটেই মুসলিম দেশগুলোতে এর বিস্তার শুরু হয়েছে। যার ফলে পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। তারা লিঙ্গ অধিকারের দাবী তুলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যাকে ‘সমকামিতা’ শব্দে প্রকাশ করা হয়
সমকামিতা’ এমন এক চেতনা যা সভ্য সকল জাতি প্রত্যাখান করে এবং তামাম আসমানী কিতাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
লূত (আ.)জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন,’সারা জাহানের মানুষের মধ্যে তোমরাই কি পুরূষদের সাথে কুকর্ম করছো?এবং তোমাদের রব তোমাদের জন্যে সৃজিত স্ত্রীগণকে বর্জন করছো?'(সুরা শূয়ারা:১৫৫-১৫৬)আল্লাহ তায়ালা লূত জাতির জনপদ উল্টিয়ে ক্রমাগত পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি দিয়েছেন
দ্বিতীয় খুতবা:
জেনে রাখুন!বিচ্ছিন্নবাদীতা যার সবকিছু মন্দ, স্বভাববিরোধী,ইলমের প্রতিবন্ধক ও সমাজ বিমুখতা। পথ থেকে ছিন্ন হওয়া,এক প্রকার গাফলতি। যা বিপর্যয় ও বিচ্যুতি উত্তরাধিকারী করে। একই সাথে বিচ্ছন্নতা প্রতারণা,প্রবঞ্চনা এবংঅস্পষ্টতায় ঘেরা।
জামাতবদ্ধ থাকার পথ ঘৃণামূলক অধীনতা নয়। প্রকৃতপক্ষে, জামাতের প্রয়োজনীয়তা এবং বিচ্ছিন্নতা ত্যাগ করাটাই যুক্তিযুক্ত, প্রজ্ঞার পরিচয়,জ্ঞানের চাহিদা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বিচ্ছন্নবাদীতা একটা রোগ। অন্যান্য রোগের মত এরও কিছু কারণ ও প্রতিকার আছে। সে কারণগুলোর কোনটি একক ও বিষয়গত এবং কোনটি সামষ্টিক ও সামাজিক।
একক কারণ: বিচ্ছিন্নবাদীর দ্বীনের ব্যাপারে একেবারে ইলম না থাকা বা স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। নিজে বড় মনে করা। ‘বিরোধ কর, আলোচনার পাত্র হয়ে যাও’ এই জনপ্রিয় উক্তির অনুসারে,জনপ্রিয়তা অর্জনে মতবিরোধে আগ্রহী হওয়া।
সামাজিক কারণগুলির মধ্যে: খারাপ সহকর্মী এবং বিভিন্ন প্রভাব। নির্ভরযোগ্য সংবেদনশীল এমন উৎসগুলোকে অবহেলা করা। যেগুলোকে অনুসন্ধানকারীরা প্রজ্ঞার জন্য গ্রহণ করেন।মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদীতায় পতিত হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও দুর্দান্ত প্রভাব রয়েছে।
শুজুজ ও বিচ্ছন্নবাদীতা নিন্দিনীয় হবে যখন সম্মিলিত সত্য পথের বিপরীতে কেউ চলে। আর এই বিচ্ছন্নবাদদিতাই প্রতিটি যুগে ও স্থানে প্রবল। তবে শুজুজ ও বিচ্ছন্নবাদীতা দূর্লভ কিছু সময় প্রশংসনীয় হতে পারে। বিশেষ করে শেষ জামানায়।
কোরআন সুন্নায় এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা হক ও সত্যের পথিক সে সময় কম হবে আর এর বিপরীত পথে থাকবে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক। এসময় বিচ্ছন্নবাদীতাই প্রশংসিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,’সেদিন দূরে নয়, যেদিন মুসলিমের উত্তম সম্পদ হবে কয়েকটি বকরী, যা নিয়ে সে পাহাড়ের চূড়ায় অথবা বৃষ্টিপাতের স্থানে চলে যাবে। ফিতনা হতে সে তার ধর্ম সহকারে পলায়ন করবে।(সহিহ বুখারী)
যেমন হুজাইফা(রা.)শেষ জামানা সম্পর্কে নবিজিকে বলেছিলেন,’যদি এ অবস্থায় পড়ে যাই। তাহলে আপনি আমাকে কি করতে আদেশ দেন? তিনি বললেন,’ মুসলিমদের দল ও তাঁদের ইমামকে আঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, যদি মুসলিমদের এহেন দল ও ইমাম না থাকে? তিনি বলেন, তখন তুমি তাদের সকল দল উপদলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করবে এবং মৃত্যু না আসা পর্যন্ত বৃক্ষমূল দাঁতে আঁকড়ে ধরে হলেও তোমার দ্বীনের উপর থাকবে।(সহিহ বুখারী) আল্লাহ তায়ালা আমাদের এগুলো থেকে হেফাজত করুন।