আরাফার মাঠে অবস্থান
আরাফার মাঠে অবস্থানকালে হাজীদের করণীয় কারজাবলিঃ
আরাফার মাঠে অবস্থানের হুকুম কি?
 এটা হজ্জের রুকন। এটা বাতিল হয়ে গেলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
 কখন আরাফাতে রওয়ানা দিতে হবে?
 আজ ৯ই যিলহজ্জ সূর্য উদয় হওয়ার পর আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবেন। এর আগ পর্যন্ত মিনাতেই অবস্থান করা সুন্নত। রওয়ানা দেয়ার সময় তালবিয়াহ ও কালিমা পড়বেন ও তাকবীর বলতে থাকবেন।
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ ু لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ ুإِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ ু لاَ شَرِيكَ لَكَ
আরাফার ময়দানে হাজীদের করণীয় কাজগুলো কী কী?
 আরাফায় পৌঁছে মসজিদে ‘নামিরা’র কাছে অবস্থান করা মুস্তাহাব অর্থাৎ উত্তম। সেখানে জায়গা না পেলে আরাফার সীমানার ভিতরে যে কোন স্থানে অবস্থান করতে পারেন। এতে কোন অসুবিধা নেই- (মুসলিম)। তবে পাশেই ‘উরানা’ নামের একটি উপত্যকা আছে। সেটি আরাফার চৌহদ্দির বাইরে। কাজেই সেখানে যাবেন না। ঐখানে অবস্থান করবেন না।
 যুহরের সময় হলে ইমাম সাহেব খুৎবা দেবেন। খুৎবার পর যুহরের ওয়াক্তেই যুহর ও আসরের সালাত একত্রে জমা করে পড়বেন। দু’ নামাযেরই আযান দেবেন একবার, কিন্তু ইকামাত দেবেন দু’বার। কসর করে পড়বেন। অর্থাৎ যুহর দু’রাকআত এবং আসরও দু’রাকআত পড়বেন। যুহরের ওয়াক্তেই আসর পড়ে ফেলবেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসী ও বহিরাগত সব হাজীকে নিয়ে একত্রে এভাবে নামায পড়িয়েছিলেন। এটা সফরের কসর নয়, বরং হজ্জের কসর। কোন নফল-সুন্নাত নামায আরাফায় পড়বেন না। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েননি।
ফর্মা-৬
 মসজিদে নামিরায় যেতে না পারলে নিজ নিজ তাবুতেই উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে জামা’আতের সাথে যুহর-আসর একত্রে যুহরের আউয়াল ওয়াক্তে দুই দুই রাক’আত করে কসর ও জমা করে পড়বেন।
 আরাফার ময়দানের সীমানা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অবশ্যই আরাফার পরিসীমার ভিতরে অবস্থান করতে হবে। আরাফার সীমানা চিহ্নিত করে চতুষ্পার্শে অনেক পিলার দেয়া আছে। এর বাইরে অবস্থান করলে হজ্জ হবে না।
 সুন্নাত হলো বেশী বেশী দোয়া করা, দোয়ার সময় হাত উঠানো, অত্যন্ত বিনম্র হওয়া, যিক্‌র করা, তাসবীহ পড়া, ‘আলহাম্‌দুলিল্লাহ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়া, তাওবাহ করা, কান্নাকাটি করে গোনাহ মাফ চাওয়া, মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, আপনজন ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য বেশী বেশী দোয়া করা।
তাছাড়া নীচের দোয়াটি আরো বেশী বেশী পড়া উত্তম :
لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهচ্ لاَ شَرِيكَ لَهচ্ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
এছাড়া নীচের তাসবীহটি বেশী বেশী পড়বেন।
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهৃ وَسُبْحَانَ اللهِ الْعَظِيْمِ
এতদসঙ্গে অন্যান্য মাসনূন দোয়া সূর্যাস্ত পর্যন্ত করতে থাকবেন। সাওয়াব কমে যাবে এমন কোন কাজ করা থেকে সাবধান থাকতে হবে।
 যখন সূর্য ডুবে যাবে এবং সূর্য অস্ত গিয়েছে এরূপ নিশ্চিত হবেন তখন প্রশান্ত মনে ধীরে সুস্থে মুযদালিফায় রওয়ানা দেবেন। এ সময় বেশী বেশী তালবিয়াহ পড়তে থাকবেন। সাবধান, কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের আগে আরাফার ময়দান ত্যাগ করা যাবে না।
আরাফার দিনে হাজীদের জন্য আল্লাহ কী কী মর্যাদা ও ফযীলত রেখেছেন?
 এ তারিখে দিনের বেলায়ই আল্লাহ তা’আলা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন।
 আল্লাহর কাছে ঐ দিনের চেয়ে উত্তম আর কোন দিন নেই।
 বান্দাদের জন্য আল্লাহ তাঁর দয়ার ভাণ্ডার খুলে দেন।
 সেদিন আল্লাহ বান্দাদের অতি নিকটবর্তী হন।
  আরাফাতে অবস্থানকারী ও মাশআরুল হারাম- বাসীকে আল্লাহ সেদিন ক্ষমা করে দেন।
 উমর রাদিআল্লাহু আনহুর প্রশ্নের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আরাফায় আগমনকারীদের জন্য এ ক্ষমা প্রদর্শন কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।
 যমীনবাসীদের নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের সাথে গৌরব করে বলেন, “আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ তারা ধূলিমলিন অবস্থায় এলোকেশে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে আমার রহমতের আশায়, অথচ আমার আযাব তারা দেখেনি। কাজেই আরাফার দিনে এত অধিক সংখ্যক লোককে জাহান্নাম থেকে আমি মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি যা অন্যদিন তারা পায়নি।
 শয়তান ঐদিন সবচেয়ে বেশী লাঞ্ছিত, হীন ও নিকৃষ্ট বনে যায় এবং তাকে ক্রোধান্বিত দেখা যায়। বান্দাদের দোয়া কবূল ও যিক্‌রের মাধ্যমে শয়তানকে বেদনাবিধুর করে দেয়া হয়।
 আল্লাহ সেদিন বলেন, এরা কি চায়? অর্থাৎ হাজীরা যা চায় তাই তিনি দিয়ে দেন।
 সেদিন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং রহমত বর্ষিত হয়।
দোয়াতে আল্লাহর কাছে কী কী জিনিস চাওয়া যেতে পারে?
 আপনার মনের যত সব হাজত আছে সবই তা প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে চাইতে পারেন আপনার ভাষায়। এছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো কিছু দোয়া আছে। বইয়ের শেষাংশে এগুলো আরবীতে ও এর বাংলা অনুবাদ দেয়া হল। দোয়াগুলো বার বার করতে থাকবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “শ্রেষ্ঠ দোয়া হচ্ছে আরাফার দিনের দোয়া।”
একটা দোয়া কতবার করা উত্তম?
 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা দোয়া সাধারণতঃ তিনবার করে করতেন। কিন্তু আরাফার মাঠে পুনরাবৃত্তি করতেন আরো বেশী পরিমাণে।
আরাফায় অবস্থান ও দোয়ার ইসলামী আদব জানতে চাই।
 আদবগুলো নিম্নরূপ :
 গোসল করে নেয়া,
 পরিপূর্ণ পবিত্র থাকা,
 কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা ও অন্যান্য তাসবীহ পড়া,
 দোয়া, তাসবীহ ও তাওবা-ইস্তিগফারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া,
 নিজের ও অন্যদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে উভয় জাহানের কল্যাণ ও মুক্তি চেয়ে দোয়া করা,
 দু’হাত উঠিয়ে দোয়া করা,
 মনকে বিনম্র ও খুশু-খুযু রেখে মুনাজাত করা,
 দোয়াতে কণ্ঠস্বর নীচু রাখা, উচ্চঃস্বরে দোয়া না করা।
যেসব দোয়ার বইয়ে কুরআন ও হাদীসের দোয়া আছে ঐসব দোয়া কি হায়েজ অবস্থায় মহিলারা আরাফার মাঠে পড়তে পারবে?
 হাঁ, পারবে। কারণ স্ত্রীসহবাস বা স্বপদোষের কারণে যে নাপাক হয় তা ইচ্ছা করলেই নিমিষের মধ্যে গোসল করে পবিত্র হওয়া যায়। কিন্তু হায়েজ-নিফাস থেকে পবিত্র হওয়া মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। বিষয়টি আল্লাহ্‌র হাতে এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য হায়েজ-নিফাসওয়ালী মহিলাদের জন্য কুরআন-হাদীসের এসব দোয়া পড়া জায়েয আছে।
আরাফায় অবস্থানের সময় কখন শুরু হয় এবং এর শেষ সময় কখন?
 দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলার পর থেকে আরাফার প্রকৃত সময় শুরু হয়। তবে ইমাম হাম্বলের মতে সেদিনের সকালের ফজর উদয় হওয়া থেকেই এ সময় শুরু হয়। আর এর শেষ সময় হল আরাফার দিবাগত রাত্রির ফজর উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
কমপক্ষে কী পরিমাণ সময় আরাফাতে থাকতে হবে?
 দিনে অবস্থানকারীর সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা।
অনিবার্য কারণবশতঃ দিনের বেলায় আরাফায় যেতে পারল না। পৌঁছল ঐদিন রাতের বেলায়। ফলে শুধু রাতের অংশেই সেখানে অবস্থান করল। তার কি হজ্জ হবে?
 এক্ষেত্রে আরাফাতে কিছুক্ষণ অবস্থান করলে তার হজ্জ হয়ে যাবে। মুযদালিফায় গিয়ে রাতের বাকী অংশ যাপন করবে।
কেউ যদি তার দেশ থেকে যিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে এসে সরাসরি আরাফার মাঠে চলে যায় তবে কি তার হজ্জ হবে?
 হ্যাঁ, হজ্জ শুদ্ধ হবে।
আরাফার দিন “জাবালে রহমতে” উঠার কোন বিশেষ সাওয়াব আছে কি?
 না, সেখানে আরোহণ করে ইবাদত ও দোয়া-তাসবীহ পাঠে সাওয়াব বেশী হওয়ার কথা কুরআন-হাদীসে নেই।
আরাফার মাঠে হাজীদের আরাফার রোযা রাখার বিধান কি?
 আরাফার দিন রোযা রাখা অত্যন্ত সাওয়াবের বিষয় হলেও আরাফায় অবস্থানকারী হাজীগণ এ রোযা রাখবে না। বিশেষ করে মাঠে অবস্থানকারী হাজীদের জন্য ঐ দিন রোযা না রাখা মুস্তাহাব, অর্থাৎ রোযা না রাখাই বিধান। কারণ খানাপিনা না খেলে এ কঠিন ইবাদতের জন্য শরীরে শক্তি পাবে না। হজ্জের এ পরিশ্রান্ত ইবাদত যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য শক্তির প্রয়োজন। তাই খাবার গ্রহণ করা জরুরী।
আরাফার দিন ঐ ময়দানে সুন্নাত-নফল সালাত পড়বে কি?
 না, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় শুধুমাত্র ফরয পড়ে দোয়ায় মনোনিবেশ করেছিলেন।
যদি আরাফার মাঠে কোন মহিলার হায়েয শুরু হয়ে যায় তখন সে কী করবে?
 অন্যান্য হাজীরা যা যা করবে উক্ত মহিলাও তাই করবে। পবিত্র হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শুধুমাত্র নামায পড়বে না এবং কাবা তাওয়াফ করবে না।
কোন কারণবশতঃ কেউ যদি অযু বিহীন বা অপবিত্র থাকে তবে তার আরাফায় অবস্থান কি শুদ্ধ হবে?
 হ্যাঁ, শুদ্ধ হবে।
১২৫- শুক্রবারে হজ্জ হলে আরাফায় জুমা নাকি যুহর পড়ব?
 যুহর পড়বেন।
মানুষ আরাফার মাঠে সাধারণতঃ কী ধরনের ভুল-ত্রুটি করে থাকে?
 হাজীদের যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি সাধারণতঃ পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নরূপ :
 কিছু লোক আরাফার সীমানার বাইরে বসে থাকে। অথচ আরাফার সীমানা চিহ্নিত খুঁটি চতুর্দিকেই দেয়া আছে। এ কাজে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।
 কিছু হাজী পাহাড়ে গিয়ে ভীড় জমায়, এর পাথর ছুঁয়ে গায়ে মুছে। এগুলো শির্ক বিদ’আতের অন্তর্ভুক্ত।
 কিছু কিছু হাজী অনর্থক কথাবার্তা, গল্পগুজব ও হাসাহাসি করে দোয়া কালাম পড়া থেকে বিরত থেকে মূল্যবান সময় নষ্ট করে হজ্জকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
 আবার কেউ কেউ দোয়ার সময় কেবলামুখী না হয়ে জাবালে রহমত পাহাড় মুখী হয়ে দোয়া করে। অথচ সুন্নাত হলো কাবার দিকে মুখ করে দোয়া করা।
 আরেকটি বড় ভুল হলো এই যে, কিছু হাজী সূর্য ডুবার আগেই আরাফার ময়দান ছেড়ে চলে যায়। এটা জায়েয নয়।
 আবার কিছু হাজী ফজরের আগেই মিনা থেকে আরাফায় রওয়ানা দেয়। সুন্নত হলো সূর্যোদয়ের পর রওয়ানা দেয়া।
 মসজিদে নামিরায় জামাআত না পেলে যুহর-আসর একত্রে না পড়ে পৃথক পৃথক ওয়াক্তে আদায় করে। এটাও ঠিক নয়।
 আরাফায় যুহর-আসর একত্রে পড়া ও দুই দুই রাক’আত করে কসর করা জায়েয মনে না করা। এটা ভুল ধারণা।
কখন কিভাবে মুযদালিফায় রওয়ানা দিতে হবে?
 সূর্য অস্ত যাওয়ার পর আরাফাতে মাগরিবের নামায না পড়ে মুযদালিফায় রওয়ানা দেবেন। পৌঁছতে দেরী হলেও মাগরিব-এশা মুযদালিফায়ই পড়তে হবে। এ দেরীকে কাযা মনে করবেন না। সেদিনের জন্য এটাই নিয়ম। সেখানে যাওয়ার সময় মোয়াল্লেমের গাড়ীতে বা কয়েকজন মিলে একজনকে গ্রুপলীডার বানিয়ে তার নেতৃত্বে দল বেঁধে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে পথ চলতে পারেন। পথে যাতে হারিয়ে না যান, কেউ যাতে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, সেজন্য গ্রুপলীডার একটি বাংলাদেশী পতাকা কাঁধে নিয়ে চলতে পারেন। সেখানেও ভীড় হয়। ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া থেকে সতর্ক থাকবেন। সাথে নারী-শিশু থাকলে আরো বেশী সাবধান থাকবেন। ভীড়ের কারণে শোয়ার জন্য খালী ভাল জায়গা অনেক সময় পাওয়া যায় না। টয়লেটেও প্রচুর ভীড় হয়। দেখে-শুনে শোয়ার জায়গা বেছে নেবেন।
তথ্যসূত্রঃ Preaching Authentic Islam In Bangla.